ইমাম খাইর, সিবিএন:
দীর্ঘদিন আন্দোলন, সংগ্রামের পর অবশেষে আলোর মুখ দেখছে দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক এলাকা শাহ্পরীর দ্বীপ। উদ্বোধন হয়েছে বেড়িবাঁধ পূনঃনির্মানের কাজ। এরই মাধ্যমে দুঃখ ঘুচবে দ্বীপের প্রায় অর্ধলাখ মানুষের।
বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় শাহপরীরদ্বীপ জিরো পয়েন্টে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর মাধ্যমে নির্মান কাজের উদ্বোধন করেন উখিয়া-টেকনাফের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি।
এসময় এমপি বদি বলেন, দীর্ঘদিন পরে হলেও এই বেড়িবাঁধ নির্মান কাজ শুরু হওয়ার ফলে শাহপরীরদ্বীপ বাসীর কষ্ট লাঘব হবে। এই বাঁধের জন্য অনেক সমালোচনা হয়েছে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় এই বাঁধে কাজ শুরু হওয়ায় মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানান। তিনি সেই সাথে সাংবাদিকদেরও ধন্যবাদ জানান।উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকোশলী মোঃ সবিবুর রহমান, জেলা পরিষদ সদস্য আলহাজ্ব শফিক মিয়া, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন সিদ্দিকী, উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, আওয়ামীলীগ নেতা জহির হোসেন এম.এ, আলহাজ্ব সোনা আলী, সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন প্রমুখ। ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য এই বেড়িবাঁধ শুরুতে ভাঙ্গন কবলিত স্থান মেরামত করা হবে। পুরো বাঁধের নির্মানকাজ ২০১৯ সালের মধ্যে শেষ হবে।২০১২ সালের ১২ জুলাই বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের আঘাতে শাহপরীরদ্বীপ পশ্চিমপাড়া ও দক্ষিণপাড়া বেড়িবাঁধের একাংশ বিলীন হয়ে গিয়েছিল। শাহপরীরদ্বীপে নতুন করে ভয়াবহ ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। সাগর একে একে গ্রাস করে নিচ্ছে উপকূলীয় এলাকার ঘর-বাড়ি, চিংড়ি ঘের, ফসলি জমি, মসজিদ-মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিস্তীর্ন জনপদ। বাড়ি-ঘর ও জমি-জমা হারিয়ে নিঃস্ব হয় অনেক পরিবার। দীর্ঘ দিন ধরে ভাঙ্গন রোধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় দূর্গতদের মাঝে বিরাজ করে চাপা ক্ষোভ। ২০১৫ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ২০১৩ সালে জলাবায়ু ট্রাস্ট থেকে এ সাগর ভাঙ্গন রোধে প্রায় ৭ কোটি টাকা, ২০১৪ সালে ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং সর্বশেষে দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ বরাদ্দ থেকে কয়েক কোটি টাকার ব্লক তৈরী করা হলেও সেগুলো সঠিক ভাবে কাজে লাগানো হয়নি। ঘূর্ণিঝড় কোমেনে এবং ঘুর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে নতুন করে বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই এ এলাকার সিংহ ভাগ এলাকা এবং ঐতিহ্যবাহী জালিয়াপাড়া জামে মসজিদ পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদ, বিদ্যালয়সহ বহু ঘর বাড়ি, আবাদি জমি, গাছ পালা সাগরের গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। রাক্ষুসী সাগর একে একে গ্রাস করে নিচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। হুমকির মুখে বিদ্যালয় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্টানসহ অসংখ্য ঘর বাড়ি। গত ৫ বছরে সাগরের ভাঙ্গনে বিশাল জনপদ সম্পূর্ণ ভাবে সাগরে তলিয়ে গেছে। বর্তমানে শাহপরীরদ্বীপের অনেক বাসিন্দা টেকনাফ ছাড়াও উখিয়া উপজেলার পালংখালী ও কুতুপালং নামক গ্রামের পাহাড়ের পাশে অস্থায়ী ভাবে বসবাস করছে। এ ভাবে দিনের পর দিন শাহপরীর দ্বীপের বিস্তীর্ন এলাকা সাগরে গ্রাস করে নিয়ে যাচ্ছে ।এরপর স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে একাধিকবার বিধ্বস্থ বেড়িবাঁধ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হলেও কোন সুফল বয়ে আনেনি। ইজিপিপি’র বরাদ্দ এবং ব্যক্তি উদ্যোগেও চেষ্টা কম হয়নি। ভয়াবহ ভাঙ্গণ রোধে কার্যকরী কোন উদ্যোগ না নেয়ায় বাঁধের ভাঙ্গন চরম আকার ধারণ করে। ফলে ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাটসহ দ্বীপের বির্স্তীণ জনপদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। শাহপরীরদ্বীপে স্থায়ী টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ৪০ হাজার জনগোষ্ঠীর প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছিল। সাগর ও নদীর পানির কারণে হতভাগা মানুষের আক্ষেপ ছিল আবার কি দ্বীপে বেড়িবাঁধ হবে?দ্বীপের ভাঙ্গন আর প্লাবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে চরম ভোগান্তিতে বসবাস যেন নিয়মে পরিণত হয় এ বিচিছন্ন জনপদের বাসিন্দাদের। এসব যারা সইতে পারেননি তারা সাগরে দ্বীপটি বিলীনের আশঙ্কায় ইতোমধ্যে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্র মতে টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নের সর্ব দক্ষিণে শাহ্পরীর দ্বীপের অবস্থান। এখানে ১৩টি গ্রাম রয়েছে। এই দ্বীপে ৪০ হাজার জনগোষ্ঠীর বসবাস করলেও বেশীরভাগ লোক অন্যত্রে অবস্থান করেছেন। বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পরপরই সাগরের পানি ঢুকে ঢেউয়ের আঘাতে শাহপরীরদ্বীপ থেকে ডাঙ্গরপাড়া পর্যন্ত সড়কটি বিধ্বস্থ হয়ে যায়। গত ৫ বছর ধরে শাহপরীরদ্বীপবাসীর যাতায়ত মাধ্যম হচ্ছে সাঁকো আর নৌকা। গত কয়েক বছর ধরে এ অবস্থা চলতে থাকায় এলাকাটির নতুন নাম সৃষ্টি হয়েছে ‘শাহপরীরদ্বীপ ভাঙ্গার মুখ’। কিছু অংশ সাঁকো আবার কিছু অংশ নৌকায় করে যেতে হয় শাহপরীরদ্বীপে। কি যে দুঃখ-দুর্দশায় আর ভোগান্তিতে ছিল শাহপরীরদ্বীপের বাসিন্দাগণ তা বলে শেষ করা যাবেনা।
এ দ্বীপের পশ্চিমে সাগর, পূর্বে নাফনদী, দক্ষিণে বদর মোকাম এলাকা বেড়িবাঁধ দিয়ে রক্ষা করা ছিল। এ বাঁধ অরক্ষিত হয়ে সাগরের পানি লোকালয় গ্রাস করছে। ফলে বসতবাড়ি, চিংড়িঘের, ফসলি জমি ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এমনকি কয়েক শত বছরের পুরানো কবরস্থান ভয়াবহ ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সাগরে বিলীন হয়ে গিয়েছে। এ অবস্থায় পুরো দ্বীপ সাগরে বিলীনের আশঙ্কা করা হয়েছিল। এবার বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে কিছুতা রক্ষা পাবে বলে আশা করছেন দ্বীপবাসী।
এদিকে ৫ বছর ধরে সাগরের রাহু গ্রাসে নিমজ্জিত শাহপরীরদ্বীপের বাসিন্দাগণ। বর্তমানে মূল-ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। দ্বীপবাসীকে ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় পারাপার করতে হচ্ছে। গত ৫ বছর ধরে চরম ভোগান্তিতে বসবাস করেছেন শাহপরীরদ্বীপের ৪০ হাজার বনি আদম। টেকনাফের সাথে যোগাযোগ রক্ষা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে যাওয়া, গর্ভবতী অসুস্থ রোগীদের টেকনাফে আনা, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের যাতায়ত, আইন প্রযোগকারী সংস্থা সমুহের যাতায়তে ভোগান্তির অন্ত ছিলনা। তার উপর লাখো রোহিঙ্গা শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।